অ্যালাবামা
অ্যালাব্যামা (ইংরেজি: Alabama) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বভাগে অবস্থিত একটি অঙ্গরাজ্য। এটির সাথে উত্তরে টেনেসি, পূর্বে জর্জিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে ফ্লোরিডা ও পশ্চিমে মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যগুলির সীমানা আছে। রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে মেক্সিকো উপসাগর অবস্থিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরাতন দক্ষিণভাগের কেন্দ্রে অবস্থিত অ্যালাব্যামা দেশটির ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সংঘাতের সাক্ষী। এজন্য এর একটি ডাকনাম হল "দ্য হার্ট অভ ডিক্সি" (অর্থাৎ "দক্ষিণের হৃৎকেন্দ্র")। ৪৫০ বছরের ইতিহাসের বিভিন্ন সময় জুড়ে এ এলাকাটি স্পেনীয়, ফরাসি, ব্রিটিশ, কনফেডারেসি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল, তাই এখানকার অধিবাসীদের ইতিহাস সচেতনতা গভীর। এখানে ইউরোপীয় অভিবাসীরা আদিবাসী আমেরিকীয় জাতিগুলির বিরুদ্ধে ভূখণ্ড দখলের যুদ্ধ করেছিল। এখানেই কনফেডারেসির জন্ম হয়, যা পুরাতন দক্ষিণের প্ল্যানটেশনভিত্তিক অর্থনীতি বজায় রাখতে চেয়েছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে মার্কিন গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আবার এখানেই ১৯৬০-এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলন ঘটেছিল। অ্যালাব্যামার রাজধানীর নাম মন্টগমারি; এটি মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় কনফেডারেসির রাজধানী ছিল। জনসংখ্যার বিচারে বার্মিংহাম বৃহত্তম নগরী।[৮] প্রায় আয়তাকার এই অঙ্গরাজ্যের আয়তন ১ লক্ষ ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (প্রায় বাংলাদেশের সমান); এটি আয়তনের বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০তম অঙ্গরাজ্য। এখানে প্রায় ৪৯ লক্ষ অধিবাসীর বাস, যার ফলে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪তম সর্বোচ্চ জনবহুল অঙ্গরাজ্য। অ্যালাব্যামা রাজ্যের নাম অ্যালাব্যামা নদী থেকে এসেছে, যে নামটি আবার সম্ভবত একটি আদিবাসী আমেরিকীয় শব্দগুচ্ছ থেকে এসেছে, যার সম্ভাব্য অর্থ "ফসল তুলে জমি খালি করা"। অ্যালাব্যামার উত্তরভাগটি মূলত অ্যাপালেচিয়ান পর্বতমালার দক্ষিণাংশ দিয়ে গঠিত। এখানকার ভূমি রুক্ষ এবং এখানে অনেক অরণ্যাবৃত পাহাড় ও শৈলশিরা রয়েছে। অ্যালাব্যামার দক্ষিণভাগ মূলত সমতল ভূমি নিয়ে গঠিত। এখানকার জলবায়ু মৃদু প্রকৃতির। গ্রীষ্মকালগুলি দীর্ঘ ও উষ্ণ, এর বিপরীতে শীতকালগুলি নাতিদীর্ঘ ও মৃদু। অ্যালাব্যামার জনগণের তিন-চতুর্থাংশই ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত (মূলত ইংরেজ, স্কটীয় ও আইরীয়)। প্রায় এক-চতুর্থাংশ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনী। অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি অধিবাসী শহর বা নগরীতে বাস করে। বার্মিংহাম অ্যালাব্যামার বৃহত্তম নগরী ও শিল্পখাতের কেন্দ্রবিন্দু। মোবিল একটি বন্দর নগরী যা মোবিল উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষায়তনটি টাসকালুসা শহরে অবস্থিত। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এসেও অ্যালাব্যামার অর্থনীতি গ্রামীণ তুলাশিল্পের উপরে নির্ভরশীল ছিল। এজন্যও আজও অঙ্গরাজ্যটির একটি ডাকনাম হল "দ্য কটন স্টেট" (তুলার অঙ্গরাজ্য)। আজও অ্যালাব্যামার ৬৭টি কাউন্টির ৫৯টিতে তুলার চাষ হয়, যেগুলির বার্ষিক তুলা উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৮ লক্ষ ৭০ হাজার বেল (২০১৭)। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অঙ্গরাজ্যটি এর কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনেছে। সয়াবিন এখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী শস্য। এছাড়া এখানকার কৃষি খামারগুলিতে চিনাবাদাম, তুলা, ভুট্টা ও পিকান বাদাম উৎপাদন করা হয়। হাঁস-মুরগী পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এছাড়া এখানে মাছ ও খোলসী মাছ (কম্বোজ-কবচী যেমন ঝিনুক, চিংড়ি, কাঁকড়া, ইত্যাদি) চাষ করা হয়। রাজ্যের বিশাল এলাকা জুড়ে পাইন ও হার্ডউড বৃক্ষের বাণিজ্যিক অরণ্য বিদ্যমান। ২০শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অ্যালাব্যামার শিল্পখাতেরও দ্রুত ও নাটকীয় উন্নয়ন ঘটে। ১৯৩০-এর দশকে এখানকার উত্তর-পশ্চিমভাগের নদীগুলির উপরে অনেক বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করা শুরু হয়, যেগুলি বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই জলবিদ্যুৎশক্তি আবার সুবৃহৎ সার, গোলাবারুধ ও অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশন শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বার্মিংহাম একটি শিল্পনগরীতে এবং মোবিল একটি প্রধান সামুদ্রিক বন্দরে পরিণত হয়েছে। নগরায়ন ও সেবাখাতের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে বাণিজ্য ও পর্যটন অ্যালাব্যামার প্রধান দুই সেবাশিল্প খাত। পর্যটকেরা এখানকার উষ্ণ আবহাওয়া ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের টানে বেড়াতে আসেন। এখানে কাগজ ও ধাতব দ্রব্যের শিল্পোৎপাদন কারখানা আছে। বিশেষ করে লৌহ আকরিক, কয়লা ও চুনাপাথরে সমৃদ্ধ বলে অ্যালাব্যামার একটি প্রধান ইস্পাত-উৎপাদক অঙ্গরাজ্য। ২১শ শতকে এসে অঙ্গরাজ্যটির অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা, মোটরযান নির্মাণ, অর্থসংস্থান, শিল্পোৎপাদন, খনিজ নিষ্কাশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খুচরা বিক্রয় ও প্রযুক্তির উপরে নির্ভরশীল।[৯] বায়বান্তরীক্ষ ও প্রতিরক্ষা শিল্পগুলিতে অ্যালাব্যামা একটি নেতৃস্থানীয় মার্কিন অঙ্গরাজ্য। এখানে দক্ষিণের সবচেয়ে উন্নত নদীব্যবস্থাগুলির একটি বিদ্যমান। অ্যালাব্যামা অঞ্চলের আদিবাসী আমেরিকীয় জাতিগুলি এখানে বড় বড় মাটির ঢিবির চারপাশে তৈরি করা গ্রামে বাস করত। ১৮শ শতকে এসে চেরোকি, ক্রিক, চোক্ত ও চিকাস' এখানকার প্রধান কয়েকটি আদিবাসী আমেরিকীয় গোত্র ছিল। টাসকালুসা শহরের কাছে এইসব গোত্রের কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মেলে। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় অভিযাত্রী এর্নান্দো দে সোতো এই এলাকাটি ঘুরে দেখেন। তখন থেকে এটি স্পেন-শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। ১৮শ শতকের শুরুতে ফরাসিরা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নেয় এখানে বহুসংখ্যক বসতি স্থাপন করে, যাদের মধ্যে ১৭০২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট লুই (বর্তমান মোবিল) অন্যতম। ১৭৬৩ সালে ফরাসিরা উত্তর আমেরিকাতে তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলি যুক্তরাজ্যের কাছে দিয়ে দেয়; তখন অ্যালাব্যামাও যুক্তরাজ্যের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। মার্কিন বিপ্লবের সময় স্পেনীয় সেনারা মোবিল শহরটি বিজয় করে নেয় এবং ১৮১৩ সাল পর্যন্ত স্পেনীয় পশ্চিম ফ্লোরিডার অংশ হিসেবে এটিকে দখলে রাখে। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্য অ্যালাব্যামাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করে। ১৮১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পেনীয়দের কাছ থেকে মোবিল শহরটি বিজয় করে নেয় এবং স্পেনীয়রা পশ্চিম ফ্লোরিডাকে মার্কিনীদের কাছে ছেড়ে দেয়। ১৮১৭ সালে অ্যালাব্যামা টেরিটরি নামক প্রশাসনিক অঞ্চলটি সৃষ্টি করা হয় এবং ১৮১৯ সালে অ্যালাব্যামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২তম অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। এটি তুলার চাষের জন্য সমৃদ্ধি লাভ করে। তবে তুলার খামারগুলির বেশিরভাগ কাজ কৃষাঙ্গ ক্রীতদাসগুলি সম্পাদন করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের মতো অ্যালাব্যামাও আশঙ্কা করছিল যে মার্কিন সরকার ক্রীতদার প্রথা রদ করে দেবে। ১৮৬১ সালে অ্যালাব্যামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এটি দক্ষিণের আরও অনেকগুলি রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়ে পৃথক একটি সরকার গঠন করে, যার নাম ছিল কনফেডারেসি। মার্কিন সেনারা মার্কিন গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসি সরকারের বাহিনীকে পরাজিত করে এবং ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৮৬৮ সালে অ্যালাব্যামা পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করে। গৃহযুদ্ধের ফলে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলেও অ্যালাব্যামাতে আফ্রিকান মার্কিনীদের জীবনযাপনের তেমন উন্নতি হয়নি। পুনর্গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সময় কৃষাঙ্গদেরকে অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাগুলি ব্যর্থ হয় এবং ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত অ্যালাব্যামা একটি বর্ণভিত্তিক পৃথকীকরণবাদী অঙ্গরাজ্য ছিল। অন্যান্য প্রাক-ক্রীতদাস অঙ্গরাজ্যগুলির মতো অ্যালাব্যামাতেও আইনপ্রণেতারা জিম ক্রো আইনগুলির মাধ্যমে আফ্রিকান মার্কিনীদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করেন। মার্কিন গৃহযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে দক্ষিণের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যগুলির মতো অ্যালাব্যামাও অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়, যার একটি কারণ ছিল কৃষির উপর ধারাবাহিক অতিনির্ভরশীলতা। যদিও বড় বড় শিল্প ও পৌরকেন্দ্র গড়ে ওঠে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ছয় দশকে অঙ্গরাজ্যের আইনসভাগুলিতে শ্বেতাঙ্গ গ্রামীন মার্কিনীদের স্বার্থই আধিপত্য বিস্তার করে। এর বিপরীতে আইনসভায় পৌর ও আফ্রিকান মার্কিনী-অধ্যুষিত এলাকাগুলির স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব ছিল অপ্রতুল। ১৯৫৫-৫৬ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মন্টগমারি শহরে একটি বাস বয়কটে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সেলমা শহর থেকে মন্টগমারি পর্যন্ত একটি প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। নাগরিক আন্দোলনের সময়ে যে নতুন আইনগুলি গৃহীত হয়, সেগুলি অ্যালাব্যামাতে আফ্রিকান মার্কিনীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাহায্য করে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বহু কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থী অঙ্গরাজ্যের রাজনৈতিক উচ্চপদে নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে অ্যালাব্যামা গভীর দক্ষিণের একটি অংশ এবং এখানকার সিংহভাগ অধিবাসী রক্ষণশীল রিপাবলিকান মতাবলম্বী। অঙ্গরাজ্যটি এর দক্ষিণী সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। মার্কিনী ফুটবল, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলিতে (যেমন অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয়, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জ্যাকসনভিল সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়) অঙ্গরাজ্যটির সংস্কৃতির প্রধান একটি অংশ। আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Information related to অ্যালাবামা |
Portal di Ensiklopedia Dunia